ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করে। আমাদের প্রতিদিনের যাতায়াতের সময় যানবাহনে উঠার দোয়া পড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত যা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিক্ষা দিয়েছেন। এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও বরকত কামনা করি এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে কোনো ধরনের যানবাহনে চড়ার সময় এই দোয়া পড়া আমাদের ঈমানী দায়িত্বের অংশ এবং এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর স্মরণে থাকি।
বর্তমান যুগে যখন আমরা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন যেমন গাড়ি, বাস, ট্রেন, উড়োজাহাজ ব্যবহার করি, তখন এই দোয়া পড়ার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এই নিবন্ধে আমরা যানবাহনে উঠার দোয়ার বিস্তারিত বিবরণ, এর অর্থ, তাৎপর্য এবং আমল সম্পর্কে জানব।
যানবাহনে উঠার দোয়ার আরবি উচ্চারণ ও বাংলা অনুবাদ

দোয়ার আরবি পাঠ
যানবাহনে উঠার দোয়া আরবিতে হলো: “سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ” (সুবহানাল্লাযী সাখখারা লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহু মুক্বরিনীন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনক্বালিবুন)। এই দোয়াটি পবিত্র কুরআনের সূরা যুখরুফের ১৩-১৪ নম্বর আয়াত থেকে গৃহীত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে কোনো যানবাহনে আরোহণের সময় এই দোয়া পড়তেন এবং সাহাবীদেরকেও এটি শিক্ষা দিয়েছেন।
বাংলা অর্থ ও ব্যাখ্যা
এই দোয়ার বাংলা অর্থ হলো: “পবিত্র মহান সেই সত্তা যিনি এটিকে আমাদের অনুগত করে দিয়েছেন, অথচ আমরা এটিকে বশীভূত করার ক্ষমতা রাখতাম না। আর নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তনকারী।” এই দোয়ার মধ্যে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসের প্রকাশ রয়েছে। আমরা স্বীকার করি যে আল্লাহ ছাড়া আমরা কোনো যানবাহনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।
দোয়া পাঠের সঠিক পদ্ধতি ও সময়

কখন দোয়া পড়তে হয়
যানবাহনে বসার ঠিক পরপরই এই দোয়া পাঠ করতে হয়। আপনি গাড়িতে উঠলেন, বাসে বসলেন, বিমানের আসনে বসলেন বা নৌকায় আরোহণ করলেন – সকল ক্ষেত্রেই এই দোয়া পড়া সুন্নত। হাদিস শরীফে এসেছে, হযরত আলী ইবনে রবীআহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন যে, তিনি হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে দেখেছেন যখন তিনি তাঁর সওয়ারিতে পা রাখলেন, তখন “বিসমিল্লাহ” বললেন এবং যখন তার পিঠের উপর স্থির হয়ে বসলেন তখন এই দোয়া পড়লেন। দোয়া পড়ার পর তিনি তিনবার “আলহামদুলিল্লাহ” এবং তিনবার “আল্লাহু আকবর” বললেন।
দোয়া পড়ার আদব
দোয়া পড়ার সময় কিছু আদব রক্ষা করা উচিত। প্রথমত, দোয়া পড়ার আগে বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। দ্বিতীয়ত, দোয়া পড়ার সময় মনোযোগী থাকা এবং এর অর্থ বুঝে পড়া উত্তম। তৃতীয়ত, সম্ভব হলে আরবিতেই দোয়া পড়া উচিত, তবে অক্ষম হলে বাংলায় অর্থসহ পড়া যেতে পারে। চতুর্থত, দোয়া পড়ার পর আল্লাহর প্রশংসা করা এবং তাঁর কাছে নিরাপদ যাত্রার জন্য দুআ করা ভালো। যানবাহনে চড়ার সময় শুধু দোয়া পড়েই ক্ষান্ত না হয়ে পুরো যাত্রাপথে আল্লাহর যিকির ও তাসবিহ পড়া উচিত।
যানবাহনের দোয়ার ফজিলত ও গুরুত্ব
দোয়া পাঠের আধ্যাত্মিক উপকারিতা
ইসলামী শরীয়তে প্রতিটি আমলের বিশেষ ফজিলত রয়েছে এবং যানবাহনে উঠার দোয়া পাঠেরও অসংখ্য ফায়দা রয়েছে। এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার যাত্রায় বরকত দান করেন এবং বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। হাদিসে এসেছে যে, যে ব্যক্তি এই দোয়া পড়ে যানবাহনে আরোহণ করে আল্লাহ তায়ালা তার যাত্রাকে নিরাপদ করেন এবং শয়তান থেকে হেফাজত করেন। এই দোয়া পাঠের মাধ্যমে আমরা আমাদের দুর্বলতা স্বীকার করি এবং একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করি।
বাস্তব জীবনে এর প্রভাব
দোয়া পাঠের বাস্তব জীবনেও ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যখন আমরা এই দোয়া পড়ি, তখন আমাদের মন শান্ত হয় এবং যাত্রায় একটি আধ্যাত্মিক প্রশান্তি অনুভূত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত দোয়া-দুরূদ পড়েন তারা মানসিকভাবে বেশি স্থিতিশীল এবং চাপমুক্ত থাকেন। এছাড়াও, এই দোয়া পড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের ইসলামী পরিচয় বজায় রাখি এবং সন্তানদের জন্য উত্তম উদাহরণ স্থাপন করি।
বিভিন্ন যানবাহনে দোয়া পাঠের নিয়ম
স্থল যানবাহনে দোয়া
স্থল যানবাহন যেমন গাড়ি, বাস, ট্রেন, মোটরসাইকেল ইত্যাদিতে চড়ার সময় যানবাহনে উঠার দোয়া পড়া সুন্নত। আধুনিক যুগে যখন আমরা দৈনিক গাড়িতে চড়ি, অফিসে যাওয়ার জন্য বাসে উঠি বা দূরপাল্লার যাত্রায় ট্রেনে আরোহণ করি, তখন প্রতিবারই এই দোয়া পড়া উচিত। অনেকে প্রশ্ন করেন যে, একই গাড়িতে একদিনে বহুবার চড়লে প্রতিবার কি দোয়া পড়তে হবে? উলামায়ে কেরামের মতে, যতবার যানবাহনে নতুনভাবে আরোহণ করা হয় ততবার এই দোয়া পড়া উত্তম
জল ও আকাশ যানবাহনে দোয়া
নৌকা, জাহাজ বা অন্যান্য জলযানে চড়ার সময়ও একই দোয়া পড়তে হয়। বিশেষত নদীমাতৃক বাংলাদেশে যেখানে অনেকে নৌকা, লঞ্চ বা ফেরিতে যাতায়াত করেন, সেখানে এই দোয়ার গুরুত্ব আরও বেশি। একইভাবে বিমানে চড়ার সময়ও এই দোয়া পড়তে হয়। কুরআনের সূরা মুমিনুনের ২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যখন তুমি নৌকায় স্থির হয়ে বস তখন বল: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের জালিম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন।” এছাড়াও হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম) এর নৌকায় ওঠার সময়ের দোয়াও রয়েছে যা জলযানে চড়ার সময় পড়া যায়: “বিসমিল্লাহি মাজরাহা ওয়া মুরসাহা” অর্থাৎ “আল্লাহর নামে এর চলা ও থামা”।
আধুনিক জীবনে দোয়ার প্রয়োগ
প্রযুক্তির যুগে ইসলামী শিক্ষা
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে যখন আমরা বিভিন্ন অত্যাধুনিক যানবাহন ব্যবহার করি, তখনও ইসলামী শিক্ষা ও দোয়ার গুরুত্ব কমে যায়নি বরং বেড়েছে। আধুনিক যানবাহনের গতি ও ঝুঁকি বেশি হওয়ায় আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। সন্তানদেরকে ছোটবেলা থেকে এই দোয়া শেখানো উচিত যাতে তারা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহকে স্মরণ করে। স্মার্টফোনে দোয়ার অ্যাপ ব্যবহার করে, গাড়িতে দোয়ার স্টিকার লাগিয়ে বা নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে এই সুন্নতকে জীবিত রাখা সম্ভব। পরিবারের সবাই মিলে যাত্রার শুরুতে দোয়া পড়লে তা একটি সুন্দর ইসলামী ঐতিহ্য হয়ে উঠতে পারে।
দোয়া মুখস্থ করার টিপস
অনেকের কাছে আরবি দোয়া মুখস্থ করা কঠিন মনে হতে পারে। এজন্য কিছু সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত, দোয়াটি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে মুখস্থ করুন। দ্বিতীয়ত, প্রতিদিন নিয়মিত অনুশীলন করুন এবং যানবাহনে চড়ার সময় পড়ুন। তৃতীয়ত, দোয়ার অর্থ বুঝে পড়লে মুখস্থ করা সহজ হয়। চতুর্থত, অডিও ক্লিপ শুনে শুদ্ধ উচ্চারণ শিখুন। পঞ্চমত, সন্তানদের সাথে মিলে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে শেখান। একটি ছোট কার্ড বা মোবাইলে নোট তৈরি করে রাখতে পারেন যাতে প্রয়োজনে দেখে নেওয়া যায়। নিয়মিত পড়লে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দোয়া মুখস্থ হয়ে যাবে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
১. যানবাহনে উঠার দোয়া কি ফরজ নাকি সুন্নত?
যানবাহনে উঠার দোয়া পড়া ফরজ নয়, বরং এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিয়মিত এই দোয়া পড়তেন এবং সাহাবীদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন।
২. দোয়াটি বাংলায় পড়লে কি একই সওয়াব পাওয়া যাবে?
দোয়া আরবিতে পড়া সর্বোত্তম এবং এটিই সুন্নত পদ্ধতি। তবে যারা আরবি জানেন না বা মুখস্থ করতে পারেননি, তারা বাংলায় অর্থসহ পড়তে পারেন। আল্লাহ তায়ালা বান্দার নিয়ত ও আন্তরিকতা দেখেন।
৩. একই দিনে বহুবার যানবাহনে চড়লে কি প্রতিবার দোয়া পড়তে হবে?
হ্যাঁ, প্রতিবার নতুনভাবে যানবাহনে আরোহণ করলে দোয়া পড়া উত্তম। উদাহরণস্বরূপ, আপনি সকালে গাড়িতে উঠলেন এবং অফিসে গেলেন, তারপর দুপুরে আবার গাড়িতে চড়ে কোথাও গেলেন – উভয় সময়ই দোয়া পড়া উচিত।
৪. ট্যাক্সি, রিকশা বা উবারে চড়ার সময়ও কি এই দোয়া পড়তে হয়?
হ্যাঁ, অবশ্যই। যে কোনো ধরনের যানবাহনে চড়ার সময় এই দোয়া পড়া সুন্নত। ট্যাক্সি, রিকশা, উবার, সিএনজি, অটোরিকশা – সব ধরনের যানবাহনেই এই নিয়ম প্রযোজ্য।
৫. শিশুদের কখন থেকে এই দোয়া শেখানো উচিত?
শিশুদের ছোটবেলা থেকেই, যখন তারা কথা বলতে শুরু করে (সাধারণত ২-৩ বছর বয়স থেকে), তখন থেকেই এই দোয়া শেখানো শুরু করা উচিত। প্রথমে সহজ করে বাংলা অর্থ বুঝিয়ে শেখানো যেতে পারে, তারপর ধীরে ধীরে আরবি শেখাতে হবে।
উপসংহার
যানবাহনে উঠার দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনুসরণ করা উচিত। এই দোয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি এবং নিরাপদ যাত্রার আশা করি। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই দোয়ার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরাম নিয়মিত এই আমল করতেন। বর্তমান যুগে যখন সড়ক দুর্ঘটনা ও যাত্রাপথের নানা বিপদ বেড়ে গেছে, তখন এই দোয়ার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অনুভূত হয়। আসুন আমরা আমাদের প্রতিটি যাত্রায় এই দোয়া পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং আল্লাহর স্মরণে থাকি।
এই ছোট্ট আমলের মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে কল্যাণ লাভ করতে পারি। পরিবারের সদস্যদের এবং সমাজের মানুষদের এই সুন্নত শেখানোও আমাদের দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এই দোয়া নিয়মিত পড়ার তৌফিক দান করুন এবং আমাদের সকল যাত্রায় নিরাপত্তা ও বরকত দান করুন। আমিন।



